বিনোদন বাজার রিপোর্ট
সোমবার (৭ এপ্রিল) নাজিমউদ্দিন রোডের পাঁচতলা ভবনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় একই পরিবারের ছয়জনের শ্বাসনালি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাদের মধ্যে ঈশার দাদি ও খালাতো বোনের শ্বাসনালি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় তাদের দুজনকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) নেওয়া হয়েছে। আর ঈশা ও তার ১১ বছর বয়সী বড় বোন ইসতিমাম হোসেন, বাবা ইকবাল হোসেন এবং মা ইশরাত জাহান ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে চিকিৎসাধীন।

নিজেদের ভবনে আগুন লাগার পর যখন নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল তখন অবুঝ শিশু ঈশা তার মায়ের কাছে জিজ্ঞাস করে ‘মা, আমরা কি এখন সবাই মারা যাবো?’ তখন ভোর ৪টা ১০ মিনিট।
এ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় মোট আহত হন ১৮ জন। তাদের মধ্যে পাঁচজনকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে। বাকি ১৩ জন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে চিকিৎসাধীন। ১৩ জনেরই শ্বাসনালি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কেউই শঙ্কামুক্ত নন বলে জানিয়েছেন বার্ন ইউনিটের চিকিৎসক।
ফায়ার সার্ভিস বলছে, ভবনটির তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম তলার বাসাগুলো থেকে মোট ১৮ জনকে উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিসের অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। ভবনটির চিনতলা ও দ্বিতীয় তলায় ফার্নিচারের দোকান ছিল। নিচতলার ফার্নিচারের দোকানটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ১৩ জন হলেন- ইকবাল হোসেন (৪৭) ও তার স্ত্রী ইশরাত জাহান (৩৬), দুই মেয়ে ইসতিমাম হোসেন (১১) ও ঈশা আয়াত (৫), ইশরাত জাহানের বোনের মেয়ে মুশফিকা আক্তার (২৫), ইকবালের মা মমতাজ বেগম (৬৫), ইউনুস মিয়া (৭৪), তার স্ত্রী লাহেলা বেগম (৬০) ও তার দুই ছেলে আমিন (২৭), বুলবুল (৩৭), মেয়ে শিল্পী আক্তার (৪০) শিল্পীর মেয়ে তালহা (০৩) ও দোকানের কর্মচারী সাকিব হোসেন (২২)।
সোমবার বিকেলে ঢামেকের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে সরেজমিনে দেখা যায়, পঞ্চম তলায় ৫০২ ও ৫০৩ নম্বর কক্ষের বেডে ১৩ জনের ১১ জন জেনারেল বেডে শুয়ে কাতরাচ্ছেন। চিকিৎসাধীন কয়েকজন ও তাদের পরিবারের কয়েকজন সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাদের ২৪ ঘণ্টা পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। রাতে আগুনের সেই দুঃসহ স্মৃতির কথা মনে হলেই গাঁ শিউরে উঠছে আহতদের।
আমার কাপড় মেয়ের নাকে দিয়ে রেখেছিলাম যাতে সেন্সলেস না হয়। শাশুড়ি ও বোনের মেয়ে দুজনের শ্বাসনালি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাদের আইসিইউতে নেওয়া হয়েছে।–আহত ইশরাত জাহান
ইশরাত জাহান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘বাসায় ছয়জন ছিলাম। আগুনে ছয়জনই দগ্ধ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি। শাশুড়ি ও বোনের মেয়েকে আইসিইউতে নেওয়া হয়েছে।’
ইকবাল হোসেনের স্ত্রী ইশরাত জাহানের গ্রামের বাড়ি বরিশালের পিরোজপুরে। স্বামীর কর্মসূত্রে ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডের মাক্কু শাহ মাজার মসজিদের সামনের ভবনটির চারতলায় দীর্ঘদিন ধরে দুই মেয়েসহ থাকতেন তারা।

ইশরাত বলেন, ‘তখন ভোর। সবাই ঘুমে বিভোর। ঘুম ভেঙে শুনি বাইরে চিৎকার-চেঁচামেচি। আগুন লেগেছে। তখন আমার স্বামীকে বললাম দ্রুত ওঠো আগুন লেগেছে, বাসা থেকে বের হতে হবে। দরজা খুলে দেখি ধোঁয়ায় সব অন্ধকার। মোবাইল হাতে নিয়ে দেখি স্ক্রিনও দেখা যাচ্ছে না ধোঁয়ার কারণে। পাশের রুমে ছিল ১১ বছরের বড় মেয়ে ইসতিমাম হোসেন (১১) বোনের মেয়ে মুশফিকা (২৫) ও শাশুড়ি মমতাজ বেগম (৬৫)। মূল দরজা খুলে আমার স্বামী কোথায় গেছে পাচ্ছিলাম না। এমন সময় আমার ছোট মেয়ে ঈশা পানি খেতে চায়। তখন ও বলে- ‘মা, আমরা কি এখন সবাই মারা যাবো?’ এর মধ্যে আমি টের পাচ্ছি ফ্লোর সব গরম হয়ে যাচ্ছে। এ সময় আমার রুমে ওয়াশরুমের বাথটাবের মধ্যে ছোট মেয়েকে বসিয়ে রাখি যাতে ও একটু স্বস্তি পায়।’
ওই মুহূর্তে কী যে অবস্থা তা কাউকেই বলে বোঝানো যাবে না জানিয়ে বলেন, ওয়াশরুমের মধ্যেই ব্রিদিং এক্সারসাইজ (শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়ম) কীভাবে করে তা ছোট মেয়ে শিখিয়েছি। আমার কাপড় মেয়ের নাকে দিয়ে রেখেছিলাম যাতে সেন্সলেস না হয়। শাশুড়ি ও বোনের মেয়ে দুজনের শ্বাসনালি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাদের আইসিইউতে নেওয়া হয়েছে।’

ইশরাত জাহান আরও বলেন, ‘আধা ঘণ্টার মতো ওয়াশরুমে থাকার পর ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা এসে বলেন, ঘরে কেউ থাকলে দ্রুত বের হন। এরপর ওয়াশরুম থেকে বের হই। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ছোট মেয়েকে কোলে নেয়, কিন্তু আমি হাঁটতে পারছিলাম না। তখন আমাকে একজন ধরে নিচে নামান। হয়তো আর আধাঘণ্টা থাকলে আমি সেন্সলেস হয়ে যেতাম। হাসপাতালে আমি ও আমার বাচ্চাটা প্রথম আসি। এরপর একে একে আমার স্বামী ও অন্যদের আনা হয়।’
তীব্র ধোঁয়ার কারণে বাথরুমে বসে ছিলাম অনেক্ষণ। গেঞ্জিতে পানি লাগিয়ে মুখ ও নাক বেঁধে রেখেছিলাম যাতে ধোঁয়া ভেতরে না যেতে পারে। এরপরেও অনেক ধোঁয়া আমার শরীরে ঢুকেছে। হয়তো বাড়ি ছেড়ে ঢাকা না এলেই ভালো হতো।- দোকানের কর্মচারী সাকিব
আহত ইউনূস মিয়ার মেয়ে জামাই শফিকুল ইসলাম জানান, তার শ্বশুর পরিবার নিয়ে ওই ভবনের পাঁচতলায় থাকেন। ভোরে নিচতলায় আগুন লাগে। এতে পুরো ভবনে ধোঁয়ার সৃষ্টি হয়। এ কারণে কেউ বাইরে বেরোতে পারেননি।
আগুন লাগা দোকানের কর্মচারী সাকিব হোসেন গণমাধ্যমকে জানান, দুই ভাইবোনের মধ্যে তিনি বড়। ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় ঢাকায় এসে মাত্র দুদিন কাজ করেন দোকানে। গ্রামে খুব অভাবে ছিলেন। গ্রামের বাড়ি যশোরের শার্শা থানায়। কাজ শুরুর তৃতীয় দিনের মাথায় আগুন লেগে তিনি এখন হাসপাতালে।
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি তখন ঘুমিয়ে ছিলাম। ম্যানেজার আমিন উদ্দিন (যিনি আগুনে মারা গেছেন) ছিলেন ওপর তলায়, আমি ছিলাম নিচে। হঠাৎ করে ডাকাডাকি শুরু হয়। ঘুম থেকে উঠে দেখি ধোঁয়ায় আছন্ন চারপাশ। ধোঁয়ায় বের হওয়ার জায়গা পাচ্ছিলাম না। আলো জ্বালালেও ধোঁয়ায় কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। এরপর চাবি নিয়ে সাঁটারের কাছে যাই, গিয়ে দেখি আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে। ওইদিক দিয়ে বেরোনোর কোনো উপায় নেই। অবস্থা খারাপ দেখে অন্ধকারের ভেতরেই বাথরুমে গিয়ে বসে ছিলাম আমি ও আমার ম্যানেজার আমিন উদ্দিন। কিছু সময় পর ধোঁয়ার কারণে ম্যানেজার জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। পরে হাসপাতালে এসে শুনি মারা গেছেন।’
দোকানের কর্মচারী সাকিব আরও বলেন, ‘তীব্র ধোঁয়ার কারণে বাথরুমে বসে ছিলাম অনেক্ষণ। গেঞ্জিতে পানি লাগিয়ে মুখ ও নাক বেঁধে রেখেছিলাম যাতে ধোঁয়া ভেতরে না যেতে পারে। এরপরেও অনেক ধোঁয়া আমার শরীরে ঢুকেছে। হয়তো বাড়ি ছেড়ে ঢাকা না এলেই ভালো হতো।’
প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে বৈদ্যুতিক গোলযোগের কারণে আগুনের সূত্রপাত হতে পারে, কারণ বৈদ্যুতিক লাইন চালু অবস্থায় ছিল। তবে তদন্ত শেষে আগুনের সূত্রপাত জানা যাবে। দ্রুততার সঙ্গে আগুন নেভানোয় আশপাশের দোকান কিংবা ভবনে আগুন ছড়ায়নি।- ঢাকা ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক কাজী নজমুজ্জামান
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের আবাসিক সার্জন ডা. হারুনুর রশীদ বলেন, ‘ভোরে ১৩ জনকে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। এদের মধ্যে ইকবাল হোসেন (৪৭) নামে একজনের দুই শতাংশ দগ্ধ হয়েছে। বাকিদের বাহ্যিক কোনো দগ্ধ নেই। তবে সবারই শ্বাসনালি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাদের মধ্যে মুশফিকা (২৫) ও মমতাজ বেগম (৬৫) আইসিইউতে আছেন। অন্য ১১ জনকে জেনারেল বেডে রেখে ২৪ ঘণ্টা পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। যেহেতু ১৩ জনেরই শ্বাসনালি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, এ কারণে ২৪ ঘণ্টা পার না হলে কিছুই বলা যাচ্ছে না।’
আগুনের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক কাজী নজমুজ্জামান বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে বৈদ্যুতিক গোলযোগের কারণে আগুনের সূত্রপাত হতে পারে, কারণ বৈদ্যুতিক লাইন চালু অবস্থায় ছিল। তবে তদন্ত শেষে আগুনের সূত্রপাত জানা যাবে। দ্রুততার সঙ্গে আগুন নেভানোয় আশপাশের দোকান কিংবা ভবনে আগুন ছড়ায়নি।’